জলবায়ু পরিবর্তনে অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের সংখ্যা বাড়ছে
প্রকাশিত : ২১ আগস্ট ২০২২ ৪:৪০ অপরাহ্ণ
সাধন সরকার : জলবায়ু পরিবর্তন সারা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। অতিবৃষ্টি, খরা, দাবানল তীব্র আকার ধারণ করেছে। বহু দেশ এখন রীতিমতো উদ্বেগ-উত্কণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে। আর এর যে নেতিবাচক ফল তৈরি হচ্ছে তার মধ্যে শিশুস্বাস্হে্যর বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শিশুর পুষ্টির জন্য জলবায়ু পরিবর্তন বড় হুমকি। জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে চরম অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের সংখ্যা বাড়ছে। উপযুর্পরি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করা পরিবারগুলো সংকটের বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। বহু পরিবার সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, নদীভাঙনের কবলে পড়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা তো আছেই, এর মধ্যে আবার করোনা মহামারিকালে কাজ হারিয়ে অগণিত পরিবার নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়েছে। এছাড়া দেশে দেশে মাত্রাতিরিক্ত মূল্যস্ফীতির কারণে দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করা পরিবারগুলো নতুন করে পড়েছে মহাসংকটে। সাধারণভাবে নিম্নমধ্যবিত্ত একটা পরিবারের উপার্জনকারী ব্যক্তির সংখ্যা যদি মাত্র একজন হয় ও পরিবারের সদস্যসংখ্যা চার কিংবা তারও বেশি হয় সেসব পরিবারের সদস্যদের প্রতিদিন পরিপূর্ণ ক্যালরি গ্রহণ করা সম্ভব নাও হতে পারে! বয়সভেদে শিশুর ক্যালরি গ্রহণের মাত্রা ঠিক না থাকলে সাধারণভাবে তা অপুষ্টি হিসেবে ধরা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দুর্যোগের শিকার হয়ে উপকূলের হাজার হাজার পরিবার উঁচু বেড়িবাঁধের ওপর বসবাস করছে। রয়েছে বাঁধ ভাঙার ভয়! ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে বাড়িঘর হারিয়ে দরিদ্র পরিবারগুলো মানবেতর জীবনযাপন করছে। এসব পরিবারের সদস্যরা শিশুদের পুষ্টি কী জিনিস তাই-ই হয়তো জানে না! আর জানলেও দারিদ্র্যের কবলে পড়া এসব পরিবারের শিশুরা পুষ্টি পায় না ন্যূনতম।
সাতক্ষীরা, খুলনা, বরগুনা, পটুয়াখালীর বহু গ্রাম প্রতিদিন জোয়ারের সময় পানিতে তলিয়ে যায়। এসব গ্রাম জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং হচ্ছে। উপকূলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলা করে নিজেরাই কোনোমতে জীবন নির্বাহ করছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাদের পিছু ছাড়ছে না। ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র পরিবার আলাদা করে শিশুর জন্য কখনো ভাবে না! শিশুর পুষ্টি নিয়ে দরিদ্র পরিবারের সদস্যদের হয়তো কোনো ধারণাই নেই! সবচেয়ে বড় কথা, জলবায়ু পরিবর্তনে একটার পর একটা দুর্যোগের শিকার ও করোনা মহামারির বাস্তবতায় আয়-রোজগার কমে যাওয়ার দরুন পরিবারের সদস্যদের পুষ্টি নিয়ে ভাবার সময় কোথায়! নতুন বিপদ হিসেবে হাজির হয়েছে মূল্যস্ফীতি। পরিবর্তনশীল বাস্তবতায় যেখানে মেপে মেপে পা ফেলতে হচ্ছে সেখানে পুষ্টির দিকে নজর দেওয়া কি সম্ভব? ফলে উপকূলবতীর্ অঞ্চলসমূহে দারিদ্রে্যর সংখ্যা বাড়ছে। দরিদ্র পরিবারের হাজার হাজার শিশু চরম অপুষ্টিতে ভুগছে। উপকূলের বহু দরিদ্র পরিবার জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে শহরে পাড়ি জমাচ্ছে। ঠাঁই নিচ্ছে শহরের কোনো বস্তিতে, নদীর তীরে বেড়িবাঁধে কিংবা রেললাইনের পাশে। নিজেরাই যেখানে জীবনযাপন ও খাদ্যের জোগাড় করতে ক্লান্ত সেখানে পরিবারের শিশুদের পুষ্টির চিন্তা করা রসিকতা ছাড়া আর কী! বন্যা, খরা, নদীভাঙনের কারণে কৃষকরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তেমনি তাদের পরিবারের শিশুরাও চরম অপুষ্টিতে ভুগছে। দারিদ্র্যের সঙ্গে অপুষ্টির সম্পর্ক বিদ্যমান। অপুষ্টির প্রধান কারণ দারিদ্র্য। তবে অন্যভাবে চিন্তা করলে পরিবারের সদস্যদের পুষ্টিজ্ঞান না থাকলেও শিশুরা অপুষ্টির শিকার হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূল অঞ্চলের হাজার হাজার পরিবার দরিদ্র হয়েছে এবং এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। উপকূলবর্তী জেলাসমূহে দারিদ্র্য বেশি, ঠিক সেই কারণেই উপকূলের শিশুরা অপুষ্টির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেও বেশি। পরিবারের আয় কমে গেলে শিশুরা অপুষ্টির শিকার হবে—এটাই স্বাভাবিক! বোধ করি, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সহসাই কাটবে না। ফলে চরম অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে! ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রায় ২ কোটি শিশু জলবায়ু পরিবর্তন বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশ্বব্যাপী তীব্রতর অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশ উপরের সারিতে। বিশ্ব স্বাস্হ্য সংস্হা (উব্লিউএইচও) মতে, মারাত্মক তীব্র অপুষ্টি পাঁচ বছর বয়সি শিশুদের মৃতু্যর প্রধান কারণ। সংস্হার মতে, প্রতিবছর সারা বিশ্বে ২ কোটি শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভোগে। আর ১০ লাখের মতো শিশুর মৃত্যু হয়। এসব শিশুর অধিকাংশই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর বাসিন্দা।
স্বাস্হ্য অধিদপ্তরের আওতাধীন জনস্বাস্হ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের সদ্য প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত বছর (২০২১) দেশের হাসপাতালগুলোয় তীব্রতম অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে আগের বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশের হাসপাতালগুলোয় চিকিত্সা নিতে আসা তীব্রতম অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা বেড়েছে আগের বছরের তুলনায় ৭২ শতাংশের বেশি। পুরো দেশের অবস্হা যখন এই, তখন উপকূলের অবস্হা সহজে অনুধাবনযোগ্য। উপকূলের মানুষের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের আঘাত যেমন বেশি তেমনি সেখানে কাজের ক্ষেত্র কম, দারিদ্র্য বেশি। উপকূলের শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগছেও বেশি। সাধারণভাবে শিশুর অপুষ্টি খালি চোখে দেখা যায় না। দীর্ঘমেয়াদি অপুষ্টি কিংবা তীব্রতর অপুষ্টির শিকার হলে শিশুর মৃতু্য পর্যন্ত হতে পারে। অপুষ্টি আবার তিন ধরনের হয়ে থাকে—সাধারণ অপুষ্টি, অনুপুষ্টির অভাবজনিত অপুষ্টি ও পুষ্টির ভারসাম্যহীনতাজনিত অপুষ্টি। অপুষ্টির নির্দেশক হলো ওজন, উচ্চতা ও বয়স। উচ্চতা ও ওজনের ভারসাম্য ঠিক না থাকলে বুঝতে হবে শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরো থেকে ‘বাংলাদেশের অপুষ্টি মানচিত্র-২০১৯’ প্রকাশিত তথ্যেও শিশুর অপুষ্টির চিত্র ফুটে উঠেছে। ইউনিসেফের তথ্যমতে, পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের মধ্যে খর্বকায় ২৮ ভাগ এবং কৃশকায় ১০ ভাগ।
অপুষ্টি শিশুর বুদ্ধি ও বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। দীর্ঘমেয়াদি অপুষ্টি শিশুর প্রতিবন্ধিতার দিকেও ঠেলে দিতে পারে। অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর উচ্চতা কম হয়, শুকনা হয়, পাতলা হয় ও রক্তশূন্যতায় ভোগে। অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় ও নানা জটিলতা দেখা দেয়। দেশের শিশুদের বিশাল একটি অংশ বিশেষ করে উপকূলের শিশুদের অপুষ্টিতে রেখে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। শিশুর অপুষ্টি বিপর্যয়ে রূপ নেওয়ার আগেই টেকসই ও পরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব যদি না থাকত তাহলে শিশুদের অপুষ্টির মতো ভয়াবহ চিত্র দেখতে হতো না। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজন করেই টিকে থাকার সময় হয়েছে। উপকূলে শিশুর পুষ্টিহীনতা দূর করতে পরিবারের অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট খাতে বিশেষ বরাদ্দ রাখতে হবে। উপকূলবাসীর জীবনমানের উন্নয়নে সামাজিক কর্মসূচির আওতায় ভিন্ন প্রকল্পে দারিদ্র্য দূর করার ব্যবস্হা রাখা দরকার। জলবায়ুগত সমস্যা যত কম হবে, দারিদ্র্য তত হ্রাস পাবে। শিশুর পুষ্টিহীনতা তত বেশি দূর হবে।
লেখক: শিক্ষক ও পরিবেশকমীর্; সদস্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)