২১শে আগস্ট হত্যাকাণ্ড ও কিছু বাস্তবতা
প্রকাশিত : ২১ আগস্ট ২০২২ ৪:৪২ অপরাহ্ণ
সামছুল আলম দুদু এমপি: রক্তের দামে কেনা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের মাটিতে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির ঔদ্ধত্য-দাপট বাঙালি জাতিকে বারবার সহ্য করতে হয়েছে। স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ইতিহাসের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে রাজনীতির কলঙ্কিত ইতিহাস সাড়া বিশ্বকে বিস্মিত করলেও ঘাতকদের ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। আজও সেই ষড়যন্ত্র অব্যাহত আছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশ অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছিল। পরম সৃষ্টিকর্তার কৃপায় শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেঁচে যাওয়ার কারণে বাঙালি জাতির মনে ক্ষীণ আশা জেগেছিল, হয়তো একদিন বাঙালি ঘুরে দাঁড়াবেই। বাঙালির এই আশা পূরণে শেখ হাসিনা বাংলার মাটিতে ফিরে আসেন এবং রাজনীতিতে সক্রিয় হন। তিনি কীভাবে এবং কী প্রক্রিয়ায় রাজনীতির মঞ্চে উপস্হিত হয়েছিলেন, তা সবারই জানা। আমি সে বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই না। আমি শুধু বলতে চাই, বিধ্বস্ত বাঙালি জাতিকে শক্তি ও সাহসের সঙ্গে অন্যায় ও অপরাধের মোকাবিলা করতে যে শিক্ষা শেখ হাসিনা দিয়েছেন, তা স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে রাজনীতির ইতিহাসে। রাজনীতির নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের বাতিঘর হয়ে আজন্ম লালিত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে চলেছেন। বারবার মৃত্যুর দুয়ার থেকে পরম সৃষ্টিকর্তার রহমতে ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছেন। আজ ২১শে আগস্টের কথাই ধরুন।
২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় হত্যার অপচেষ্টা করেছিল এই বিএনপি-জামাত জোট। উল্লেখ্য, ২০০১ সালের দেশি ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের নির্বাচনে সফল নেত্রী শেখ হাসিনাকে হারিয়ে দেওয়া হয়। স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি যারা ১৯৭৫-পরবর্তী ২১ বছর ক্ষমতার মসনদে ছিল, সেই শক্তিকে পরাজিত করে ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়েছিল। রাজনীতি ও সামাজিক অবক্ষয়ের বাংলাদেশকে শেখ হাসিনা টেনে তুলেছিলেন। দীর্ঘদিনের নষ্ট রাজনীতিকে স্বচ্ছতায় ফিরিয়ে এনেছিলেন। জনতার অধিকার প্রতিষ্ঠায় সাফল্য দেখিয়েছিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করতে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। জাতির পিতাসহ অন্যান্য রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ উন্মুক্ত করেছিলেন আইনসম্মতভাবে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কণ্টকাকীর্ণ পথকে মসৃণ করেছিলেন। কোনোরূপ জিঘাংসা চরিতার্থ করেননি।
১৯৯৬ থেকে ২০০১-এর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশ শাসন করে আন্তর্জাতিক মহলেও প্রশংসিত হয়েছিলেন। জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রথম দফায় ক্ষমতায় এসেই দেশে অভূতপূর্ব সংস্কার এনেছিলেন। কিন্তু পরাজিত শক্তি যারা স্বাধীনতাকে মেনে নিতে পারেননি, যারা বাংলাদেশকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করতে সদা তত্পর, সেই বিএনপি-জামায়াত ভয়ংকরভাবে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে। ২০০১-এর অক্টোবরে নির্বাচনে জয়লাভ করেই তাণ্ডবলীলা শুরু করে দেয়। এর আগে শেখ হাসিনা প্রথম দফায় প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ২০০০ সালের ২০ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রাখা হয়েছিল। সেদিন কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনার সমাবেশ ছিল। সেই সমাবেশস্হলে বোমা পুঁতে রাখার উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যা করা। বিএনপি-জামায়াত মদতপুষ্ট তথাকথিত ইসলামি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের শীর্ষনেতা মুফতি আব্দুল হান্নানের নেতৃত্বে এমন ভয়ানক কাজটি করা হয়েছিল।
সেই ঘটনায় শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এনে মামলা করেছিল কোটালীপাড়া থানা পুলিশ। পুলিশ তদন্তের পর ১৬ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দিয়েছিল ২০০১ সালে। চার্জশিট হলেও মামলাটি দীর্ঘ সময় বিচার কার্যক্রমের অপেক্ষায় ছিল। পরবর্তী সময়ে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে মামলার কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রাখে। উপরন্তু, শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য নানাভাবে ষড়যন্ত্র করতে থাকে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ভয়ংকর গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল জননেত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে (বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ) ট্রাকে অস্হায়ী মঞ্চ করে আওয়ামী লীগের সমাবেশ হচ্ছিল। সন্ত্রাস ও বহুবিধ অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে সেই সমাবেশে অসংখ্য নেতাকর্মী উপস্হিত ছিলেন। নির্যাতিত সাধারণ মানুষও সেই সমাবেশে জননেত্রী শেখ হাসিনার ভাষণ শুনতে উপস্হিত হয়েছিল। সমাবেশের শেষ পর্যায়ে শেখ হাসিনার ভাষণদানকালে ভয়াবহ হামলাটি করা হয়। মানববর্ম তৈরি করে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে রক্ষা করতে পারলেও ২৪ জন নেতাকর্মীর প্রাণ চলে যায় গ্রেনেড হামলায়। মহিলা আওয়ামী লীগের জননন্দিত সাধারণ সম্পাদক আইভি রহমানেরও প্রাণ চলে যায় সেই হামলায়। কী মর্মান্তিক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আর্তনাদ-চিত্কারে ঢাকার আকাশ-বাতাসও যেন কেঁদে উঠেছিল। ট্রাকের নিচের পাটাতনেও একটি গ্রেনেড পাওয়া গিয়েছিল। ভাগ্যিস, সেটি বিস্ফোরিত হয়নি। মুহুর্মুহু হামলায় সমাবেশস্হলের মানুষ প্রাণ বাঁচাতে ছোটাছুটি করতে থাকে। তখন বিএনপি-জামায়াতের পেটুয়া বাহিনী কাঁদানো গ্যাস নিক্ষেপ করে আহতদের হাসপাতালে নেওয়ার সুযোগও বন্ধ করে দিয়েছিল। তাত্ক্ষণিক জননেত্রী শেখ হাসিনা গাড়িতে চড়ে সমাবেশ ত্যাগ করেছিলেন এবং তার গাড়ি লক্ষ্য করে পুলিশ গুলি চালিয়েছিল।
একটি প্রধান বিরোধী দলের সমাবেশে এহেন হামলা নজিরবিহীন ঘটনা। আজ বলতে দ্বিধা নেই, বিএনপি-জামায়াত ও তাদের সহযোগী অন্যান্য সংগঠন এ দেশের মাটিকে রক্তে রঞ্জিত করেছে বারবার। সে জন্য এসব সংগঠনকে রাজনৈতিক দল বলা যায় না। সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে এরা বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করেছে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর থেকেই এই গোষ্ঠী নানাভাবে দেশবাসীকে যন্ত্রণা দিয়েছে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়ার স্বপ্নই ছিল দেশটিকে পাকিস্তান বানানো। তাই তিনি জাতির পিতার হত্যাকারীদের পুরস্কৃত করেছিলেন। বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে সামরিক ছাউনি থেকে জনগণের ট্যাক্সের টাকা ব্যয় করে রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন, যার নাম দিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে তিনি জনগণের আবেগ কাজে লাগিয়েছিলেন। রাজনৈতিক শঠতার আশ্রয়ে জিয়া দেশটাকে জাহান্নামের দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন। যে দল জাতির পিতা মানে না, তারা কি স্বাধীনতা মানতে পারে? সে জন্যই স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমূলে উত্পাটন করার লক্ষ্যে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছিল। তার গঠন করা রাজনৈতিক দল তার আদর্শ লালন করেই দেশে ভয়ের সংস্কৃতি চালু রেখেছে। বিএনপি-জামায়াত জোটের কর্মকাণ্ড নিয়ে লিখতে হলে হাজার হাজার পৃষ্ঠা লেখা যাবে। তাদের ভয়ংকর কর্মকাণ্ড বাঙালির হূদয়মনকে তছনছ করে দিয়েছে।
বিএনপি-জামায়াত মানেই একটি আতঙ্কের নাম, বিএনপি-জামায়াত মানেই জঙ্গী সন্ত্রাসের নাম। বিএনপি-জামায়াত মানেই স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি। স্বাধীন-সার্বভৌম দেশে এই অপশক্তির বিরুদ্ধে বাঙালি জেগে উঠেছে। আর কোনো দিন ওরা যাতে ক্ষমতার মসনদে বসতে না পারে, সেই দিকটায় খেয়াল রাখতে হবে সবাইকে। আবার যদি ওরা কোনোভাবে ক্ষমতায় ফিরে আসে, তবে উদ্ধার করা স্বাধীনতা বিপন্ন হয়ে যাবে। বিপর্যস্ত হবে বাঙালির জীবন। ঐক্যবদ্ধভাবে সবাইকে এই অপশক্তির মোকাবিলা করতে হবে। আমাদের অস্তিত্বের স্বার্থে, উন্নয়নের স্বার্থে।
লেখক: রাজনীতিক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় স্হায়ী কমিটির সদস্য